মহামারী চুক্তি ২০২৫(Pandemic Treaty 2025) হল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর নেতৃত্বে প্রস্তাবিত একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা ভবিষ্যত মহামারী মোকাবিলায় একটি সমন্বিত বৈশ্বিক কাঠামো তৈরি করতে চায়। যদিও অনেক দেশ এই চুক্তিকে সমর্থন করছে, কিছু দেশ এর বিরোধিতা করছে, যার ফলে স্বাক্ষরকারী ও অস্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে।
এই নিবন্ধে মহামারী চুক্তি ২০২৫-এর উদ্দেশ্য, প্রধান বিধানাবলী, সমর্থক ও বিরোধী দেশগুলোর তালিকা, এবং এটি কীভাবে বৈশ্বিক শাসন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে, তা বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
মহামারী চুক্তি ২০২৫(Pandemic Treaty 2025)-এর পটভূমি
উৎপত্তি ও উদ্দেশ্য

COVID-19 মহামারী বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা উন্মোচন করেছে, যেমন:
- বিলম্বিত আন্তর্জাতিক সমন্বয়
- টিকা বণ্টনে অসমতা
- বিচ্ছিন্ন জনস্বাস্থ্য নীতি
এসব সমস্যা সমাধানে WHO একটি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক চুক্তি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়, যার লক্ষ্য:
- বৈশ্বিক পর্যবেক্ষণ ও প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা
- চিকিৎসা সুবিধার (টিকা, ওষুধ, ডায়াগনস্টিক্স) ন্যায্য প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা
- প্রাদুর্ভাব রিপোর্টিংয়ে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা
- দেশগুলোর মধ্যে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার মানসম্মতকরণ
প্রধান খেলোয়াড় ও সময়রেখা
- ২০২১: WHO সদস্য দেশগুলি চুক্তি খসড়া করতে সম্মত হয়
- ২০২৩: সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও বেসরকারি খাতের সাথে আলোচনা তীব্র হয়
- ২০২৪-২০২৫: চূড়ান্ত আলোচনা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা
মহামারী চুক্তি ২০২৫(Pandemic Treaty 2025)-এর প্রধান বিধানাবলী/Key Provisions of the Pandemic Treaty

১. বৈশ্বিক নজরদারি ও তথ্য ভাগাভাগি
দেশগুলোকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলতে হবে:
- প্রাদুর্ভাবের তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে রিপোর্ট করা
- রোগজীবাণুর জেনেটিক সিকোয়েন্সিং ডেটা শেয়ার করা
- WHO-এর তদন্তে সহায়তা করা
২. চিকিৎসা সম্পদের ন্যায্য বণ্টন
এই চুক্তির প্রস্তাবনা:
- একটি বৈশ্বিক টিকা ও ওষুধের মজুদ গঠন
- জরুরি অবস্থায় পেটেন্ট সুবিধা স্থগিত করা
- নিম্ন-আয়ের দেশগুলোর সাথে প্রযুক্তি হস্তান্তর বাধ্যতামূলক করা
৩. মানসম্মত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা
WHO নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো সুপারিশ (বা বাধ্যতামূলক) করতে পারে:
- লকডাউন
- ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা
- বাধ্যতামূলক টিকাদান
৪. অর্থায়ন ব্যবস্থা
এই চুক্তির পরামর্শ:
- ধনী দেশগুলোর অর্থায়নে একটি বৈশ্বিক মহামারী তহবিল গঠন
- সদস্য দেশগুলোর বাধ্যতামূলক আর্থিক অবদান
স্বাক্ষরকারী ও অস্বাক্ষরকারী দেশ/Signed vs. Non-Signed Countries

যেসব দেশ চুক্তিকে সমর্থন করছে বা স্বাক্ষর করেছে
বিশেষত ইউরোপ ও আফ্রিকার অনেক দেশ চুক্তিটিকে সমর্থন করছে, যেমন:
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) সদস্য
- জার্মানি – বৈশ্বিক স্বাস্থ্য শাসনকে শক্তিশালী করতে চায়
- ফ্রান্স – টিকার ন্যায্য বণ্টন ও তথ্য শেয়ারিং সমর্থন করে
- ইতালি – WHO-এর নেতৃত্বে মহামারী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে সমর্থন করে
অন্যান্য সমর্থক দেশ
- দক্ষিণ আফ্রিকা – চিকিৎসা সুবিধার ন্যায্য প্রবেশাধিকারের পক্ষে
- কানাডা – মহামারী প্রস্তুতির জন্য তহবিলিং ব্যবস্থাকে সমর্থন করে
- অস্ট্রেলিয়া – বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মানসম্মতকরণ চায়
এই দেশগুলো কেন চুক্তিকে সমর্থন করছে?
- COVID-19-এর সময় সমন্বয়হীনতার অভিজ্ঞতা
- ভবিষ্যত মহামারীতে চিকিৎসা সরঞ্জামের নিশ্চয়তা পেতে চাওয়া
- বহুপাক্ষিক সহযোগিতায় বিশ্বাস
যেসব দেশ চুক্তির বিরোধিতা করছে বা স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছে
কিছু দেশ এই চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করছে, যেমন:
যুক্তরাষ্ট্র
- সার্বভৌমত্ব হারানোর আশঙ্কা
- WHO-এর অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের ভয়
- ডেমোক্র্যাট (সমর্থক) ও রিপাবলিকান (বিরোধী) দলের মধ্যে বিভক্তি
যুক্তরাজ্য
- ব্রেক্সিট-পরবর্তী বৈশ্বিক চুক্তিতে সন্দেহ
- বাধ্যতামূলক আর্থিক অবদানের বিরোধিতা
ব্রাজিল
- জাতীয়তাবাদী সরকার বৈদেশিক হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না
- জাতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়
ভারত
- পেটেন্ট ছাড়ের ফলে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে
- মহামারী মোকাবিলায় নমনীয়তা চায়
রাশিয়া ও চীন
- পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন উদ্যোগের সাথে বৈরিতা
- WHO-এর নির্দেশনার চেয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি পছন্দ করে
এই দেশগুলো কেন চুক্তির বিরোধিতা করছে?
- সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়োজনীয়তা
- WHO-এর কার্যকারিতা ও নিরপেক্ষতায় অবিশ্বাস
- বাধ্যতামূলক নিয়ম ও অর্থায়নের বিরোধিতা
মহামারী চুক্তি ২০২৫-এর নেতিবাচক প্রভাব/Negative Effects of the Pandemic Treaty 2025

১. জাতীয় সার্বভৌমত্বের ক্ষয়
- দেশগুলোর নিজস্ব স্বাস্থ্য নীতি নির্ধারণের স্বাধীনতা কমে যেতে পারে।
- WHO জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে জাতীয় সরকারগুলোর সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করতে পারে।
২. অর্থনৈতিক ক্ষতি
- লকডাউন ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এর ফলে:
- ব্যবসা বন্ধ
- চাকরি হারানো
- সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন
- বাধ্যতামূলক তহবিল জাতীয় বাজেটের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
৩. ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ
- বাধ্যতামূলক টিকাদান বৈশ্বিক নিয়মে পরিণত হতে পারে।
- ডিজিটাল স্বাস্থ্য পাসপোর্ট নজরদারি বাড়াতে পারে।
৪. ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব
- পেটেন্ট ছাড়ের ফলে ওষুধ গবেষণায় বিনিয়োগ কমতে পারে।
৫. বৈষম্যমূলক ক্ষমতা কাঠামো
- ধনী দেশগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাধান্য পেতে পারে।
- চুক্তিটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হতে পারে।
বিতর্ক ও বিরোধিতা
১. স্বচ্ছতার অভাব
সমালোচকরা বলছেন, আলোচনায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কম এবং গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছে।
২. আইনি ও সাংবিধানিক সংঘাত
কিছু দেশের স্থানীয় আইনের সাথে এই চুক্তির বিরোধ দেখা দিতে পারে।
৩. কর্তৃত্ববাদী শাসনের ঝুঁকি
- সরকার জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার করে নাগরিক স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদী জরুরি আইনে গণতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
উপসংহার: একটি বিভক্ত বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
মহামারী চুক্তি ২০২৫ সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে একটি স্পষ্ট বিভক্তি তৈরি করেছে। যদিও অনেক দেশ এটিকে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মনে করে, অন্যরা এটিকে সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি ও স্বাধীনতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে।
এই চুক্তির সাফল্য নির্ভর করবে:
- বৈশ্বিক সমন্বয় ও জাতীয় স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা
- স্বচ্ছ ও ন্যায্য আলোচনা নিশ্চিত করা
- অস্বাক্ষরকারী দেশগুলোর উদ্বেগ সমাধান
চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগে সচেতনতা ও গণতান্ত্রিক আলোচনা জরুরি, যাতে এটি সত্যিকার অর্থে মানবতার সেবা করে—স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধিকে বিসর্জন না দিয়ে।