ভূমিকা.
আমাদের উদ্দেশ্য নিজেদের জীবনের পরিবর্তন। নিষ্ঠার সঙ্গে এর জন্য চেষ্টা করলে আমাদের মধ্যে সত্যিই এমন সুন্দর পরিবর্তন আসবে, যা দেখে অন্যেরা অনেকে চমৎকৃত হবে, উৎসাহিত হবে। তখন তারাও চেষ্টা করবে, আর তাদের জীবনেও একই রকম সুন্দর পরিবর্তন আসবে। এভাবে অনেকের জীবন ভালোর দিকে পরিবর্তিত হতে থাকলে ক্রমে ক্রমে সমাজে আমরা এমন অনেক মানুষ পাবো, যাদের জীবন সুন্দর। সুন্দর মানে এখানে – যেটা কল্যাণকর। সুতরাং এমন সব মানুষ যথাসম্ভব সকলের কল্যাণের জন্য জীবন ধারণ করবে। তারা সমাজে-সংসারে যেখানেই থাকুক, তাদের কাজে কথায় চিন্তায় সমাজের কল্যাণ হবে, দেশের কল্যাণ হবে।

Image- becomingminimalist
এটা কথার কথা নয়, বাস্তব সত্য
এটা কথার কথা নয়, বাস্তব সত্য। কাজে করলে ফল পাওয়া যাবে। ফল পেলে খুব আনন্দ হবে, আরও পেতে ইচ্ছে হবে। এসব কথা শোনার পর আমরা সাধারণত বেশ একটা উৎসাহ বোধ করি। সকলে না হলেও অনেকেই ভাবি যে, এবার আর সময় নষ্ট করবো না, লেগে পড়বো, জীবনটা হেলায় নষ্ট করবো না, সুন্দর করে যত্নের সঙ্গে গড়ে তুলবো। কদিন হয়তো বলে দেওয়া অভ্যেসগুলোও শুরু করি। কিন্তু এই উৎসাহটা বেশীর ভাগের ধরা থাকে না, খুব চট করে হারিয়ে যায়। যেন অনেকটা সেই স্কুলে পড়া ভৌত পরিবর্তনের মত – ঠাণ্ডায় রাখলে জল বরফে পরিণত হয় বটে, কিন্তু আসলে তার ভেতরের পরিবর্তন হয় না, জলের অণুগুলোর ধর্ম একই থাকে ; আবার বাইরে রাখলে তাপ পেয়ে বরফ জল হয়ে যায়! বস্তুর স্থায়ী পরিবর্তন হয় রাসায়নিক পরিবর্তন হলে ; অর্থাৎ তার ভেতরের অণুগুলোর যখন পরিবর্তন হয়, অন্য অণু তৈরী হয়, সেগুলোর ধর্ম পাল্টে যায়। যেমন, জলে বিদ্যুৎ প্রবাহ পাঠিয়ে যদি হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন অণু তৈরী হয়, সেই পরিবর্তন স্থায়ী হয়; সেগুলোকে সহজে আবার জলে পরিণত করা যায় না। আর সেগুলোর ধর্মও আলাদা আলাদা ।
আমাদের ভেতরে ভৌত বা রাসায়নিক পরিবর্তন করতে হবে, তা নয়

আমাদের ভেতরে ভৌত বা রাসায়নিক পরিবর্তন করতে হবে, তা নয়। ঐ উদাহরণের মানে হল স্থায়ী পরিবর্তন আনতে হবে জীবনে। ভালোর দিকে এমন স্থায়ী পরিবর্তন আপনা-আপনি হয়ে যায় না, সচেতন থেকে অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়, তবে হয়। আর তার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। স্বামী বিবেকানন্দ তাই বলেছেন, এটা দুর্বলের কাজ নয়, আমাদের শক্তি চাই। শরীরে বল, মনে তেজ, হৃদয়ে অদম্য উৎসাহ চাই। স্বামীজী বলেছেন, আমাদের মধ্যে অনন্ত শক্তি আছে ; আমরা সেটা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করলেই সেই শক্তি জেগে উঠতে শুরু করবে। তবেই আমরা নিজেদের ভেতরে স্থায়ী ও সার্বিক পরিবর্তন ঘটাতে পারবো । সার্বিক পরিবর্তন চাই – আমাদের সবদিক থেকে বড় হতে হবে, বিকশিত হতে হবে। যে বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে আমরা জন্মেছি, তাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে, আর সেই ফুটে-ওঠা ফুলের মত সুন্দর জীবন যতটুকু পারি দিতে হবে দেশের জন্য ৷
আর একটু ভেবে দেখা যাক
আর একটু ভেবে দেখা যাক – এই পরিবর্তনের ঠিক মানে কি ! আমরা যেভাবে চলি, যেভাবে কথা বলি, মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করি, যেভাবে নিজের কাজ করি, আনন্দ করি, সেই সবের মধ্যে অনেক ভালো গুণ প্রকাশ পায়। সেই গুণগুলোকে বাড়াতে হবে। আমি সৎ, সত্য কথা বলি, কিন্তু হয়তো ছোটোখাটো সমস্যা এড়ানোর জন্য একটা-দুটো মিথ্যেও বলি। আমি একটু চেষ্টা করলেই কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে সত্যকে ধরে থাকতে পারবো। এই গুণটা হল সততা। সততা ভালোভাবে অর্জন করতে পারলে আমার আত্মসম্মানবোধ বেড়ে যাবে, মনের শক্তি বৃদ্ধি পাবে, অন্যরাও আমাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করবে, উঁচু চোখে দেখবে। এটা আমরা বাস্তবে করে দেখলে দেখবো – ব্যাপারটা কতো সুন্দর ও সহজ ! আবার ধরা যাক আত্মবিশ্বাসের কথা। “আমি পারি, আমি পারবো”- এই ভাবনাটা যার যত বেশী থাকে, যে বারবার কোন চেষ্টায় ব্যর্থ হলেও এই ভাবনাটা ধরে রাখতে পারে, সেই জীবনে সফল হয়। স্বামী বিবেকানন্দ র বই যদি প্রতিদিন পড়ি, এই কথাগুলো বারবার ভেতরে গেঁথে যাবে। সেইভাবে চলার একটা জোরালো ইচ্ছে ভেতরে তৈরী হবে। একবার-দুবার চেষ্টা করে হয়তো দেখছি, বেশ মনের জোর বাড়ছে। তারপর হঠাৎ হয়তো একদিন একটা বড় ধাক্কা এলো, আর মনের জোর সব মুহূর্তের মধ্যে উবে গেল ! কিন্তু স্বামীজীর বই পড়ার অভ্যাস থাকলে আবার যখন পড়বো, বা স্বামীজীর ছবিটা দেখবো, আবার মনে হবে “নাঃ, হাল ছাড়বো না, আমি পারবো, আমি লড়াই করবো, আরও ভালো করে করবো।”
এরকম চেষ্টা করতে করতে দেখবো – আমাদের এইরকম সব গুণগুলো বাড়ছে

এরকম চেষ্টা করতে করতে দেখবো – আমাদের এইরকম সব গুণগুলো বাড়ছে। নিয়মিত চেষ্টা করতে করতে ভেতরে একটা স্থায়ী পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে বস্তুর রাসায়নিক পরিবর্তনের মত। এখন আমি স্বাভাবিকভাবে, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অন্যরকম ভাবি, অন্যভাবে চলি। চারিদিক থেকে ভুল পথের হাতছানি এলেও আমাকে টলাতে পারে না। একেই বলে চরিত্র তৈরী হওয়া। বারবার চেষ্টা করতে করতে ভালো অভ্যাস তৈরী হয়েছে, সেগুলো একদম ভেতরে বসে গিয়ে আমার স্বভাবগত হয়ে গেছে। এখন আলাদা করে চেষ্টা করে ভালো পথে যেতে হচ্ছে না, আপনা থেকেই মন টানছে ভালোর দিকে।
এমনটা সবদিকে নাও হতে পারে
এমনটা সবদিকে নাও হতে পারে। হয়তো কিছু ভালো গুণ আমার মধ্যে বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায়, কিন্তু কিছু গুণের অভাব রয়ে গেছে, কারণ আগে সেগুলোর দিকে নজর দিইনি। ভালো নয়, কল্যাণকর নয়, উচিত নয়, এমন কিছু ঝোঁক যদি আমার মধ্যে থাকে, বেশ প্রবলভাবে থাকে, তা হলে সেগুলো নিয়ে কি করা যায় ? প্রথমে একটু ভেবে নিতে পারি-কেন সেগুলো ভালো নয়, কেন
সেগুলো আমায় মানায় না, আর কেনই আমি ওদিকে ঝুঁকে যাই। বৈজ্ঞানিকের মত বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝে গেলে তারপর আর ঐ নিয়ে বেশী ভাবার দরকার নেই। যেটা দরকার, সেটা হল উল্টোদিকে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করে দেওয়া। এটা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটার মতো, তাই শক্তি বেশী লাগে। কিন্তু সাঁতারুর মতই মনটা থাকবে গন্তব্যের দিকে, মানসিকতা হবে ইতিবাচক। “হায় হায়” করলে বা উদ্বেগ ইত্যাদি নেতিবাচক মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিলে ক্ষতিই হবে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, কাশীর দিকে এগোলে কলকাতা এমনিই পিছিয়ে পড়ে। সেরকম ভালোর দিকে যাওয়ার চেষ্টা জোরদার হলে উল্টো জিনিসগুলো এমনিই দূরে সরে যেতে থাকবে। হয়তো আমি সহজেই খুব রেগে যেতাম তখন হিতাহিত-জ্ঞান থাকতো না। এখন রাগ উঠতে শুরু করলেই আমি সচেতন হয়ে যাই, সুস্থ চিন্তা আর ভালোবাসা দিয়ে মনটাকে ভরিয়ে তুলি। সরাসরি রাগ তাড়াতে গিয়ে আগে ব্যর্থ হয়েছি, কিন্তু এখন দেখবো ভালোবাসার ভাব আর ভালো চিন্তার প্রভাবে রাগ আপনা থেকে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে !
একটানা এইরকম চেষ্টা চালিয়ে যেতে হলে যে শক্তি দরকার

একটানা এইরকম চেষ্টা চালিয়ে যেতে হলে যে শক্তি দরকার, সেটার জন্য প্রথমে চাই সুস্থ সবল শরীর আর ধীর স্থির প্রফুল্ল মন। সুতরাং খাওয়াদাওয়া ছাড়াও প্রতিদিন একটু খেলাধুলা বা ব্যায়াম করে শরীর ঠিক রাখতে হবে। মনেরও কিছু আহার দরকার, ব্যায়াম দরকার। আহার মানে যেটা বাইরে থেকে আহরণ করি, input দিই। অল্পবয়সীদের মনের জন্য পুষ্টিকর আহার হল স্বামীজীর জীবনী ও বাণী এবং মহামণ্ডলের বইগুলো বইগুলো পড়লেই হল না, হজম করতে হবে। বেশী খেয়ে বদহজম হলে আর খাওয়ার ইচ্ছে থাকে না। উপায় হচ্ছে – যেটুকু পড়লাম, সেটুকু নিয়ে চিন্তা করা, ভালো করে বোঝা, আর বুঝে যেগুলো ভালো লাগবে, সেগুলোর অর্থ ও তাৎপর্য অন্তর দিয়ে
গভীরভাবে ভাবা
গভীরভাবে ভাবা – মাঝে মাঝেই ঘুরে ফিরে ভাবা -বারবার ভাবা। তা হলে সেগুলো আমরা মন থেকে গ্রহণ করতে পারবো। কিন্তু কাজে না লাগালে ঠিক ঠিক গ্রহণ হল না। চিন্তাগুলোকে কাজে রূপ দেওয়া, কাজে প্রকাশ করা হল মনের ব্যায়াম। এই ব্যায়াম সারাদিন চলতে থাকবে। আলাদা আলাদা করে প্রত্যেকটা চিন্তা বা ভাব সব সময় মনে থাকে না, তার প্রয়োজনও নেই, যদি আমরা নিজেদের বুদ্ধির ব্যবহার করে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত বিচার করে ঠিক জিনিসটা করি। বুদ্ধির অনেক ব্যবহার আছে। এই বিশেষ ব্যবহারটিকেই আমরা ‘বিবেক’ বলি । ‘বিবেক’ কথাটার আরও গভীর অর্থ আছে, ‘কিন্তু সহজ করে আমাদের জন্য এইটিই বিবেকের প্রয়োগ। সারাদিন বিবেককে জাগ্রত রেখে চেষ্টা করে গেলেই সব হবে।
সারদিন কাজেকর্মে শরীরের কিছু ব্যায়াম হলেও
সারদিন কাজেকর্মে শরীরের কিছু ব্যায়াম হলেও ভালো ফল পেতে গেলে যেমন আলাদা করে ব্যায়াম করা দরকার, ঠিক সেইরকম – সারাদিন বিবেকের ব্যবহার করে চললেও মনের আলাদা একটা ব্যায়াম খুব ভালো ফল দেয়। সেটা হল মনঃসংযোগ – মনের একাগ্রতা বাড়ানোর অভ্যাস। মনঃসংযোগের শুরুতে সকলের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করতে হয়। এটা বলা যেতে পারে হৃদয়ের ব্যায়াম। মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি হল হৃদয়বত্তা মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। স্বামীজীর আর অন্যান্য মহাপুরুষদের জীবনী পড়লে দেখবো যে জিনিসটা তাঁদের অনন্য করেছে, সকলের পূজ্য করেছে, সেটা শারীরিক বল, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা বা সাংগঠনিক ক্ষমতা নয় সেটা তাঁদের হৃদয়, যা সকলের জন্য তীব্রভাবে অনুভব করেছে বিশেষ করে দুঃখী মানুষের জন্য। সেই অনুভূতি থেকে তাঁরা নিজেদের জীবনকে একেবারে উজাড় করে দিয়েছেন সকলের কল্যাণের জন্য। তাঁরা সারা জীবন কষ্ট করেছেন, সংগ্রাম করেছেন শুধু অপরের জন্য। সেইসব কাহিনী পড়লেই হৃদয়ের আহার হবে। কল্যাণ-প্রার্থনা আর সাধ্যমত একটু স্বার্থশূন্য সেবার মাধ্যমে আমাদের জীবনে সেই অনুভূতির প্রয়োগ করতে হবে। যে কোন ক্ষমতা বাড়ানোর উপায় হল সেটির উপযুক্ত প্ৰয়োগ বা ব্যবহার। যত ব্যবহার করবো, তত সেই ক্ষমতা বাড়বে। যত অব্যবহারে ফেলে রাখবো, তত সেই ক্ষমতা কমবে। ক্ষমতার নিয়মিত প্রয়োগ বা ব্যবহারই তার ব্যায়াম ৷
একটু ভাবলেই বুঝতে পারবো
একটু ভাবলেই বুঝতে পারবো – মানুষের গঠনে এই তিনটি উপাদান আছে
-দেহ, মন ও হৃদয় । আহার ও ব্যায়ামের সাহায্যে এই তিনটিরই বিকাশ পাশাপাশি একসঙ্গে হলে তাকে বলে সুসমঞ্জস বিকাশ শুধু দেহ-মনের শক্তি বাড়ল, কিন্তু হৃদয়ে প্রেম নেই – এমন মানুষ স্বার্থপর দৈত্যে পরিণত হতে পারে, আর দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন মানুষ ক্ষমতায় থাকলে কি হয়, তা আমরা দেখছি। আবার হৃদয়ে প্রেম আছে, অন্যের জন্য অনুভূতি আছে, কিছু করার ইচ্ছে আছে, কিন্তু কি করা দরকার, তা বোঝার মত বুদ্ধি বা মনের জোর নেই – তাকে দিয়েও কাজ হবে না। আর কাজ করতে গেলে শরীরের শক্তি তো অপরিহার্য! সুতরাং আমাদের জীবনে সুসমঞ্জস বিকাশের চেষ্টা করতে হবে।
উপসংহার
আর দেহ, মন ও হৃদয়ের সুসমঞ্জস বিকাশ কিন্তু একই জিনিসকে দু-দিক থেকে বোঝা । এই সবটা মিলে যেটা হয়, তাকেই জীবন গঠন বলা হয়। এতে নিজের ভেতরে এমন অপূর্ব পরিবর্তন ঘটে যায়, এমন স্থায়ী পরিবর্তন ঘটে যায় যে, সাধারণ একটি কিশোর বা যুবক আর ‘সাধারণ’ থাকে না, ‘অসাধারণ’ হয়ে ওঠে। এমন লক্ষ লক্ষ অসাধারণ কিশোর-যুবক দেশ জুড়ে তৈরী করতে হবে, তবেই দেশের মানুষের দুঃখ ঘুচবে, নতুন মহিমময় ভারতবর্ষ গড়ে উঠবে। এর শুরু কিন্তু নিজেকে দিয়ে। এসো, আমরা সকলে আর দেরী না করে লেগে পড়ি ।
Content Source – Vivek Jivan